রাখাইন করিডোর দ্রুত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। উত্তর রাখাইনে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য মানবিক করিডোর হিসেবে গড়ে ওঠা এই প্রবেশপথটির নেপথ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল লুকিয়ে আছে। রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ আরাকান আর্মির (এএ) হাতে চলে আসার সাথে সাথে, তারা এখন মিয়ানমারের বেশিরভাগ ভূখণ্ডের উপর দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে। এই করিডোরটি যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে, বাংলাদেশের এই প্রতিযোগিতার ফাঁদে আটকা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মানবিক সাহায্যের পেছনে কৌশলগত অভিপ্রায়
জনসমক্ষে করিডোরটি উত্তর রাখাইনের জন্য একটি মানবিক সাহায্য রুট হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। সেখানে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষ, সংঘাত এবং বাস্তুচ্যুতির মুখোমুখি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজার সফরের সময় মানবিক সংকটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য হ্রাসকে ‘অপরাধ’ বলেও উল্লেখ করেন। কিন্তু রাখাইন করিডোরের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশল রয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। এই করিডোরটি শুধু সহায়তাই পৌঁছে দেবে না বরং বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক সংযোগস্থলে পশ্চিমা প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করবে। এই রুটটি খোলার জন্য জাতিসংঘ-মার্কিন-বাংলাদেশ প্রস্তাব ঢাকার প্রিটোরিয়ান গার্ড- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এই পরিকল্পনাকে ‘রক্তাক্ত করিডোর’ বলে সমালোচনা করেছেন, যা সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণের সাথে আপস করার ঝুঁকি তৈরি করবে। এই করিডোরটি আক্ষরিক অর্থে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য চীনের পরিধিতে অবস্থিত মিয়ানমারে নরম বা কিছুটা দৃঢ় শক্তি প্রদর্শনের একটি সম্ভাব্য উপায় হতে পারে।
বাংলাদেশের দ্বিধা
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের চাপের মুখে এই করিডোরে আগ্রহ দেখিয়েছে। একই সঙ্গে ইউনূস সামরিক বাহিনীর চাপের মধ্যেও রয়েছেন, যারা এই করিডোরকে একটি ফাঁদ হিসেবে দেখে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য ওয়াকারের মন্তব্য ইউনূসকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে, তিনি সংস্কার প্রক্রিয়া বিলম্বের মাধ্যমে নির্বাচনের বৈধতা খুঁজছেন। জেনারেল ওয়াকার এবং প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের মধ্যে এই মতবিরোধ কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। জেনারেল ওয়াকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ১৯৮০-এর দশকের পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যখন সোভিয়েত-বিরোধী মুজাহিদিনদের প্রতি মার্কিন সমর্থনের জন্য পাকিস্তানকে দীর্ঘমেয়াদী মূল্য চোকাতে হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল রাজনীতিতে ইসলামী উগ্রপন্থা, দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের স্থায়ী আধিপত্য এবং জিয়া উল-হক, পারভেজ মোশাররফ এবং পরবর্তী সরকারগুলোর অধীনে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে বিরাজমান অস্থিতিশীলতা। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রস্তাবিত রাখাইন করিডোরকে মার্কিন-আফগান খেলার বইয়ের একটি বিপজ্জনক অধ্যায় হিসেবে দেখে। এর জেরে বাংলাদেশ মিয়ানমারে একটি প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার এবং মার্কিন প্রভাব বলয়ের আরও গভীরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছে।